নিজস্ব প্রতিবেদক :
শিক্ষার্থীরা আগ্রহী না হওয়ায় ফাঁকা থেকে যাচ্ছে সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক আসন। ফলে শিক্ষার্থী সঙ্কটে ভুগছে ওসব প্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনো কোনো কোর্সে ফাঁকা আসনের হার ৯০ শতাংশও ছাড়াচ্ছে।
সর্বশেষ গত ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষেও দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আসন ফাঁকা ছিল প্রায় ৩৭ শতাংশ। মূলত কারিকুলামের দুর্বলতা, প্রচারণার অভাব, শিক্ষক সংকট ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলোয় ফাঁকা থেকে যাচ্ছে বিপুলসংখ্যক আসন।
কিন্তু আসন ফাঁকা থেকে থাকলেও সরকার কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) থেকে আপত্তি জানানো হলেও ফাঁকা আসন পূরণের উদ্যোগ না নিয়েই নতুন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে চলেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
কারিগরি শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ৩৪টি ডিগ্রির অধীনে ৩৪৬টি টেকনোলজি/ট্রেড/স্পেশালাইজেশনে (বিভাগ) শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। এসব বিভাগে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে মোট আসন ছিল ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৫টি।
এর বিপরীতে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে ৯৮ হাজার ৪৬ জন। আসন ফাঁকা ছিল ৫৬ হাজার ৮৪৯টি। সে অনুযায়ী, সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৩৬ দশমিক ৭০ শতাংশ আসন ফাঁকা রয়েছে। টানা পাঁচ শিক্ষাবর্ষ ধরে সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ৩০ শতাংশের বেশি আসন ফাঁকা থাকছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে। ওই সময় এসব প্রতিষ্ঠানে ফাঁকা আসন ছিল ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। আর সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে। করোনার অভিঘাতে সে সময় প্রতিষ্ঠানগুলোয় ফাঁকা আসন দাঁড়ায় ৪৭ দশমিক ৪২ শতাংশে।
আর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) ও নতুন প্রতিষ্ঠিত টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজগুলোয় (টিএসসি) এ সংকট বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। মূলত ?কারিগরি শিক্ষায় বর্তমানে সবচেয়ে বড় সংকট শিক্ষক ও প্রচারণার অভাব। শিক্ষাক্রম বা ডিগ্রির দিক থেকে সবচেয়ে বেশি আসন ফাঁকা থাকছে জাতীয় দক্ষতামান বেসিক (৩৬০ ঘণ্টা) শিক্ষাক্রমে।
এ শিক্ষাক্রমে ৪০ হাজার ৫৭০টি আসনের মধ্যে ৩৮ হাজার ৯৮টিই ফাঁকা, যা মোট আসনের প্রায় ৯৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া এইচএসসি ভোকেশনালে প্রায় ৫৭ দশমিক ৬৪ ও জেএসসি ভোকেশনালে ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ আসন শূন্য। এর আগে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে এ তিন শিক্ষাক্রমের মধ্যে জেএসসি ভোকেশনালের কার্যক্রম নতুন হলেও জাতীয় দক্ষতামান বেসিক (৩৬০ ঘণ্টা) ও এইচএসসি ভোকেশনালে বিগত শিক্ষাবর্ষেও যথাক্রমে ৯৫ দশমিক শূন্য ৮ ও ৪৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ আসন শূন্য ছিল। সূত্র জানায়, এদেশে কারিগরি শিক্ষায় বড় চ্যালেঞ্জ হলো এখানে ধরেই নেয়া হয় কারিগরি শিক্ষা কম মেধাবীদের জন্য। তাই যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখায় মনোযোগী তারা এখানে পড়তে চায় না।
কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্ট বাড়াতে হলে প্রথমে এ ধারণা দূর করতে হবে এবং এ-সংক্রান্ত প্রচারণা বাড়াতে হবে। আর কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্ট বাড়ালে সাধারণ শিক্ষায় এনরোলমেন্ট কমবে। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চয়ই চাইবে না তাদের শিক্ষার্থী কমুক। সেক্ষেত্রে যদি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়ও কারিগরির কোর্সগুলো চালু করা যায় তাহলেও শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়বে এবং নতুন প্রতিষ্ঠান নির্মাণেরও প্রয়োজন হবে না। জাতীয় দক্ষতামান বেসিক (৩৬০ ঘণ্টা) ও এইচএসসি (ভোকেশনালে) উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসন ফাঁকা থাকলেও এ দুই শিক্ষাক্রমে ক্রমাগত আসন বাড়াচ্ছে সরকার।
২০২২ সালে জাতীয় দক্ষতামান বেসিকে (৩৬০ ঘণ্টা) আসন সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার। এ সময় শুধু টিটিসিগুলোয় জাতীয় দক্ষতামান বেসিক (৩৬০ ঘণ্টা) শিক্ষাক্রম চালু ছিল। তবে ২০২৩ সালে আরো বেশকিছু কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ শিক্ষাক্রম চালু করা হয় এবং প্রায় ৪ হাজার ৫৭০টি আসন বাড়ানো হয়। ২০২২ সালে এইচএসসিতে (ভোকেশনাল) আসন সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৮৮০ এবং ২০২৩ সালে আসন সংখ্যা ৬ হাজার ২০০টি বাড়ানো হয়। এ ছাড়া গত ২৯ আগস্ট সারা দেশে উপজেলা পর্যায়ে আরো ৫০ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) স্থাপনের প্রকল্প একনেকে পাস হয়।
সূত্র আরো জানায়, দেশে কারগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার বাড়াতে হলে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের চেয়েও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। যদি ভালো শিক্ষক থাকে তাহলে অবকাঠামো যেমনই হোক না কেন শিক্ষার্থীরা শিখতে পারবে। সেজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভালো মানের শিক্ষক নিশ্চিত করা। তাই কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে হলে শুধু নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করলেই হবে না। বরং এরইমধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোর প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে অধিক জোর দিতে হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন আইএমইডির পক্ষ থেকেও বিদ্যমান টিটিসিগুলোর মানোন্নয়ন না করে নতুন করে সেন্টার স্থাপন না করার সুপারিশ দেয়া হয়েছিল।
গত জুনে দেশে নতুন প্রতিষ্ঠিত ২৭টি টিটিসি নিয়ে এক প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করেছিল সংস্থাটি। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রশিক্ষণের বিষয় যুগোপযোগী ও আধুনিক না হওয়া, ব্যবহারিকের সুযোগ না থাকা, প্রশিক্ষক সংকটসহ নানা জটিলতায় টিটিসিগুলো উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিবেদনের উল্লিখিত জরিপে দেখা যায়, প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ-বিদেশে ৩০ শতাংশ প্রশিক্ষণার্থী কাজে যুক্ত হলেও ৭০ শতাংশই কাজ না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত।
এসব কারণে বিগত কয়েক বছরে টিটিসিগুলোয় উল্লেখযোগ্য হারে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যাও কমেছে। এদিকে শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের মতে, কারিকুলামের দুর্বলতা, প্রচারণার অভাব, শিক্ষক সংকট ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলোয় আসন সংখ্যা শূন্য থাকছে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ শতাংশের বেশি শিক্ষক মনে করেন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক পাঠক্রমের বেশির ভাগ কোর্স বর্তমান বাজারের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম নয়।
https://slotbet.online/